আশা-নিরাশায় দুলছে বিএনপির বৃহত্তর ঐক্য

bnp logoডেস্ক রিপোর্ট: যত আশা, তারও বেশি নিরাশায় দুলছে সরকারবিরোধী দলগুলোর বৃহত্তর ঐক্য। এই ঐক্যপ্রক্রিয়ার বিএনপির সঙ্গে অন্তত পাঁচটি রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত রয়েছে। ঐক্যে আগ্রহী দলগুলো চায় ক্ষমতার ‘ভারসাম্য’। এই চাওয়ায় মতানৈক্য না থাকলেও আন্দোলনের আগে ‘আসনভিত্তিক সমঝোতা’ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের। সব পক্ষ থেকেই আশাবাদের কথা বললেও বিএনপি তাকিয়ে আছে সময়ের দিকে।

গত দুই সপ্তাহে ‘জাতীয় ঐক্য’ সম্পর্কে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রায় প্রত্যেকেই দ্বিধাগ্রস্ত। ‘ঐক্যের’ ব্যাপারে আশাবাদী হয়েও এই বিষয়ে সময় নির্ধারণ করতে পারছে না কোনও পক্ষই। এখনপর্যন্ত তৈরি হয়নি কেন্দ্রীয় কোনও সমন্বয় কমিটি। আলাপ চলছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির কয়েকজনের মধ্যে। তাদের ভাষ্য, ‘ঐক্য প্রক্রিয়া একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।’

বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের আলোচনা চলছে পাঁচটি দলের সঙ্গে। এই দলগুলো হচ্ছে, বিকল্প ধারা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য ও গণফোরাম। এর মধ্যে বিকল্প ধারার সভাপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছেন মির্জা ফখরুল। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

সাক্ষাৎ ও আলোচনা-পর্ব সেরে নিলেও এখনপর্যন্ত এর কোনও সুনির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি হয়নি। এমনকী ২০ দলীয় জোট ও জোটের শরিক জামায়াতকে রেখে কীভাবে ঐক্য প্রক্রিয়া সামলাবে বিএনপি, এখনও এই প্রশ্নেরই মীমাংসা হয়নি। তবে আগ্রহী দলগুলোর নেতাদের প্রায় সবাই-ই একমত, জামায়াতকে সঙ্গে রেখে কোনও ঐক্য হবে না। ধীরে-ধীরে জামায়াতকে সরিয়ে দিতে হবে বিএনপির।

বিকল্প ধারার সূত্র বলছে, বর্তমান সরকার চূড়ান্তভাবে একদলীয় সরকারব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। বিএনপি এই ঐক্য গড়তে বাধ্য হবে। বিশেষ করে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পরও সাংগঠনিকভাবে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারায় বিএনপির জন্য সরকারবিরোধী ঐক্য গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাহী বি চৌধুরী বলেন, ‘ঐক্য জরুরি। দেশের গণতন্ত্র নিহতপ্রায়। এ পরিস্থিতিতে এমন একটা ফ্যাসিস্ট সরকার দেশে বিরাজমান। যাকে এককভাবে ফাইট করার মতো ক্ষমতা কারও নেই। আর কারও যদি এককভাবে ফাইট করার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে ফাইট এতদিনে হয়ে যেতো। বিএনপি তো ফাইট করতে পারছে না। আমরাও তো এককভাবে ফাইট করে পারছি না। সুতরাং আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে।’

বিকল্প ধারার চিন্তায় আরও একটি বিষয় কাজ করছে, সেটি হচ্ছে আগামী নির্বাচনের আগে-পরে দেশে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা। বিশেষ করে বাংলাদেশের অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ‘যেকোনও সংঘাতময় পরিস্থিতিই’ সামনে রাখছেন দলটির নীতি-নির্ধারকরা। তারা চাইছেন, আগামীতে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে হলে অবশ্যই সরকারগঠনে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে। আর এর মোক্ষম উপায় হচ্ছে, নির্বাচনি আসন। আসনবণ্টনে ভারসাম্য থাকলেই ক্ষমতায় ভারসাম্য থাকবে, এমনটি মনে করছেন বিকল্প ধারার অনেক নেতা।

মাহী বি চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য খুব সহজ কাজ নয়। একেকজন একেক কারণে ঐক্য চান। প্রত্যেকের একটা নিজস্ব রাজনৈতিক গন্তব্য থাকে। আর এই জায়গাটায় ঐকমত্যের আগপর্যন্ত ঐক্য হবে না। ফলে, সবাইকে নিয়ে বসে ঐকমত্যে আসা কঠিন। অবশ্যই এই ঐক্য যেন ভারসাম্যের ভিত্তিতে হয়।’

ভারসাম্য সৃষ্টির চিন্তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও যুক্তফ্রন্টের সমন্বয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, ‘ঐক্যের কাঠামো তৈরি করা সময়ের দাবি। ঐক্য নিয়ে দ্রুত সমাধানের দিকে যেতে হবে। এক্ষেত্রে কাঠামোর ভিত্তি কী হবে, সংক্ষিপ্তভাবে এর একটি রূপরেখা বানাতে হবে। যেখানে খুন, গুম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিচার ব্যবস্থা—সর্বোপরি গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য ঐক্য হতে হবে।’

যুক্তফ্রন্টের আরও একনেতার ভাষ্য, ‘এখন পর্যন্ত ঐক্যের কোনও কাঠামো তৈরি হয়নি।পুরোটাই বায়বীয়। যদিও ঐক্য নিয়ে আশা এখনও ছাড়িনি।’

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না আরও বলেন, ‘বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য’ গড়ে তোলা এখন সময়ের প্রয়োজনীয়তা। আমাদের মধ্যে যে ফ্যাসিবাদ চেপে বসেছে, তাকে সবাই মিলে বিদায় করতে হবে। এই ঐক্য প্রক্রিয়াগত ও সাংগঠনিকভাবে এগিয়েছে, বলা যায় না। তবে আমি একটি বৃহত্তর ঐক্যের ব্যাপারে এখনও আশাবাদী।’

গত মাসের শেষ দিকে বিএনপির মোশাররফ হোসেন ও মওদুদ আহমদের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের বৈঠকটি ‘সফল’ বলে প্রচারিত হচ্ছে। মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘আলোচনায় ড. কামাল খুব আন্তরিক ছিলেন।’ মওদুদ আহমদ আলোচনার সাফল্য নিয়ে আশাবাদী হলেও প্রশ্ন উঠছে অন্যত্র। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের ওই বৈঠকে দু’টি ‘কমন স্টেটমেন্ট’ দেওয়া-নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই স্টেটমেন্ট গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি।

গণফোরাম নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা হয়েছে। তারা তাদের মতো কথা বলবেন, অন্যরাও কথা বলবেন। এরপর নির্বাচনের সময় একটি অ্যালায়েন্স হতে পারে।’

ড. কামালের সঙ্গে বিএনপির আলোচনা হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেক নেতার। যুক্তফ্রন্টের প্রভাবশালী একনেতার মন্তব্য, ‘তিনি তো বিএনপির সঙ্গে কথা বলেই দেশের বাইরে গেছেন। দেশের ক্রান্তিলগ্নে তিনি বিদেশে যান, আগামীতেও যাবে। আর তাতে কী রাজনৈতিক ঐক্য হবে না?’

এ রিপোর্ট লেখার সময় ড. কামাল হোসেন বিদেশে রয়েছেন। আগামী চার-পাঁচদিনের মধ্যে তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে বলে জানান তার দলের নেতা সুব্রত চৌধুরী।

ঐক্যের অন্যতম উদ্যোক্তা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সরকার মনে করছে, বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য হলে তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে। জাতীয় ঐক্য না হলে লাভ হবে না। দুই সপ্তাহের মধ্যে ফয়সালা হতে হবে।আগস্টের মধ্যে মাঝামাঝি সবাই একমত না হলে বোঝা যাবে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগই থাকছে। এর কোনও পরিবর্তন আসছে না।’

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এ ধরনের ঐক্য তো একদিনে হয় না, সময় লাগে। কাজ চলছে। আর টাইম দিয়ে তো ঐক্য হয় না।’

এদিকে, বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যে জামায়াতকে সরিয়েই সামনে এগিয়ে আসবে হবে বিএনপিকে। যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের নেতারা বলছেন, স্বাধীনতাবিরোধী দলটিকে রেখে কোনও আলোচনা সফল হবে না।

গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘জামায়াতকে বাদ দিয়েই ঐক্য হতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে মাহী বি চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি কীভাবে আসবে, এটা তাদের ব্যাপার। তাদের এই জোট গত দশ বছরে কতটুকু সফল, সেটাকে বিবেচনা করতে হবে। এই বিবেচনা রেখেই তারা ঐক্য করতে আসবেন। তবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রজন্ম জাতীয় ঐক্য স্থাপন হবে বলে বিশ্বাস করি না, আমিও বিশ্বাস করি না।’

তবে জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, ‘ঐক্যের টেবিলে আসার আগে জামায়াতকে ছাড়া সঠিক হবে না। এক্ষেত্রে যে টেবিলে আলোচনার সূত্রপাত্র হবে, সে টেবিলেই বাদ দেওয়া যাবে।’ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ আশাবাদী, জামায়াত নিজে থেকেই সরে যাবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য অবশ্য এখনও সন্দিহান বৃহত্তর ঐক্য নিয়ে। তিনি বলেন, ‘যারা ঐক্যে আগ্রহী, তারা ঠিক কোন জায়গা ধরে কাজ করবেন, সেটা ঠিক করতে হবে। আর সংগ্রামের মূল লড়াইটাই বিএনপির সঙ্গে।’ এই সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন ঐক্যের নেতৃত্ব নিয়েও। যদিও যুক্তফ্রন্টের প্রভাবশালী একজন নেতার উত্তর, ‘নেতৃত্ব বিএনপির কাছেই যাবে, তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।’ সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন