রেমিট্যান্সে অঞ্চলভেদে বৈষম্য, প্রশিক্ষণে মিলতে পারে সুফল

প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত্তি। এই অর্থ দেশের বৈদেশিক লেনদেনকে চলমান রাখছে।

ভূমিকা রাখছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গঠনে। আবার বৈদেশিক বাণিজ্যের রসদও যোগাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স এমন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারলেও ঠেকে যাচ্ছে আঞ্চলিক সমতার প্রশ্নে। অর্থাৎ রেমিট্যান্স কিছু উন্নত অর্থনীতির জেলায় আসছে অনেক বেশি। আবার কিছু অনুন্নত জেলায় আসছে অনেক কম। ফলে দিনে দিনে রেমিট্যান্স আহরণ বাড়লেও এর সুফল সব অঞ্চল সমানভাবে পাচ্ছে না। এজন্য বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার তাগিদ দিচ্ছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। আবার প্রবাসে যাওয়ার আগ্রহ কম, এমন অঞ্চলে বিদেশ গমনের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথাও বলছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবাসী আয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, দেশের উন্নত জেলাগুলোতে তুলনামূলক বেশি পরিমাণে প্রবাসী আয় আসছে। কম আসছে অনুন্নত উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্যাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত জেলাগুলোতে।

সবচেয়ে বেশি ঢাকা জেলায়, সবচেয়ে কম রাঙামাটিতে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে প্রবাসী আয় এসেছে দুই হাজার ১৭৮ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এর মধ্যে একক জেলা হিসাবে রাজধানী ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে চট্টগ্রাম জেলায়। বাণিজ্যের রাজধানী খ্যাত এ জেলায় নয় মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ১৮১ কোটি ডলার। কুমিল্লা জেলায় এসেছে ১১৬ কোটি ২৮ লাখ ডলার, সিলেট জেলায় ৯৯ কোটি ১০ লাখ ডলার, নোয়াখালী জেলায় ৬৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার এবং ফেনী জেলায় এসেছে ৬৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। ঢাকা জেলায় প্রবাসী আয় এসেছে চট্টগ্রাম জেলার প্রায় চার গুণ, ৭১৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।

সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে রাঙ্গামাটি জেলায়। পাহাড়-হ্রদের এ জেলায় উল্লিখিত নয় মাসে এক কোটি ৯৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এরপর বান্দরবানে এক কোটি ৯৯ লাখ ডলার, লালমনিরহাটে দুই কোটি ডলার, ঠারকুরগাঁওয়ে দুই কোটি ৮৯ লাখ ডলার, পঞ্চপড়ে দুই কোটি ৫১ লাখ ডলার এবং জয়পুরহাটে তিন কোটি ১২ লাখ ডলার এসেছে।

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলের প্রচুরসংখ্যক মানুষ বিদেশে থাকেন। দশকের পর দশক এসব জেলার তরুণরা কর্মের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত কোনো মাধ্যমে অথবা সরকারি আনুষ্ঠানিকতায়। ফলে এই পরম্পরায় সেখানে প্রবাসীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে প্রবাসী আয়।

অন্যদিকে উত্তরাঞ্চল বা পাহাড়ি জেলাগুলোতে বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ একেবারেই কম। পিছিয়ে পড়া জেলাগুলো নিয়ে প্রবাসী শ্রমিক ও গবেষকরা বলছেন, বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে অর্থ লাগে তা দেওয়ার সক্ষমতা না থাকা, প্রবাসে কর্মরত আত্মীয়-স্বজন না থাকা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সচেতনতা না থাকার কারণে এসব অঞ্চলের মানুষ কাজের সন্ধানে বিদেশে কম যান। যে কারণে সেসব জেলা বা অঞ্চলে প্রবাসী আয়ও কম আসে।

প্রশিক্ষণসহ সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দরকার
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, উত্তরাঞ্চলের মানুষ বরাবরই পিছিয়ে। এজন্য উত্তরাঞ্চলের লোকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানো দরকার। কিন্তু বাস্তবে সে ধরনের উদ্যোগ নেই। তাছাড়া বিদেশে যাওয়ার জন্য খরচ যেহেতু বেশি, এই অর্থ জোগাড় করা কঠিন হয়ে যায়। বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াও অনেক জটিল, মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালনির্ভর। আবার উত্তরাঞ্চলের মানুষ বিদেশে কম থাকেন বলে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগও কম। এজন্য উত্তরাঞ্চলের মানুষ বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।

তিনি বলেন, অভিবাসনের ক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চলের যে মনস্তত্ত্ব সে কারণেও তারা অনেকদিন পিছিয়ে ছিল। তারা দেশের বাইরে যেতে চাইতো না। এদিক থেকে যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে কুমিল্লা ও সিলেটের তরুণরা দেশের বাইরে বেশি যায়। এজন্য এসব অঞ্চলে দেখা যাবে ধানকাটা বা অন্য কোনো কায়িক শ্রমে তরুণদের পাওয়া যায় না। অথচ ওই সময়ে উত্তরাঞ্চলের লোকজন কাজ পাচ্ছে না, রোজগার কম, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। একই দেশে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় বিপরীত চিত্র। সেজন্যই উত্তরাঞ্চলে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রবাসী আয়ের সামঞ্জস্য আনা প্রয়োজন। সরকারের জন্য এ ধরনের কাজ খুবই জরুরি।

প্রবাসী বাড়লেও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির হার কম, নেপথ্যে অদক্ষতা
দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজের সন্ধানে বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু এসব মানুষ যেমন প্রশিক্ষিত নন, আবার সেই দেশের ভাষাজ্ঞান সম্পর্কেও অধিকাংশ অজ্ঞ। ফলে জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির হার কম। গত এক দশকের জনশক্তি ও প্রবাসী আয় পর্যালোচনা করলে এমনই তথ্য মেলে।

হিসাব মতে, ২০১৫ সালে বিদেশে কাজের সন্ধানে লোকবল গিয়েছিল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন। ওই বছরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল এক হাজার ৫২৭ কোটি ডলার। এক দশকের মাথায় ২০২৪ সালের বাৎসরিক জনশক্তি রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন। আর প্রবাসী আয় আসে দুই হাজার ৬৮৯ কোটি লাখ ডলার। ১০ বছরে জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর প্রবাসী আয় বেড়েছে ৭৬ শতাংশ। প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি যেখানে বেশি হওয়ার কথা ছিল সেখানে কমেছে।

শরিফুল হাসান বলেন, সৌদি আরবেই গত চার বছরে ২০ লাখ জনশক্তি গেছে। চার বছর আগে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স আসতো ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। এখন সেখান থেকে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার আসছে।

তিনি বলেন, ১৫ বছর আগে যদি ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসতো, সেটা এখন বেড়ে ৩০ বিলিন ডলার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রেমিট্যান্স সেই একই জায়গায় আটকে আছে। এর বড় একটি কারণ হলো আমরা অদক্ষ শ্রমিক পাঠাচ্ছি। উপজেলা-জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো হচ্ছে, সেগুলো হলো যে দল ক্ষমতায় আসে তাদের ইচ্ছাপ্রশিক্ষণ ভবন। কোনো কাজের কাজ হয় না। এই যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হচ্ছে, এখানে কোন মানের কর্মী হচ্ছে, কোন সার্টিফিকেট দিচ্ছে, তারা আদৌ কোনো দেশে যেতে পারছে কিনা, সার্টিফিকেশন ঠিক আছে কিনা, তারা আন্তর্জাতিক মানের কর্মী তৈরি করতে পারছে কিনা-সেই বিষয়গুলো যাচাই-বাচাই হয় না বললেই চলে। ফলে সমস্যাগুলো আমাদের চিহ্নিত, কিন্তু সমাধানে যে উদ্যোগ নেওয়ার দরকার, কর্মকৌশল দরকার, শিক্ষা থেকে শুরু দক্ষতা বৃদ্ধির যে উদ্যোগ দরকার সেটার কোনোটাই হয় বলে চোখে পড়ে না।

বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে সবচেয়ে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকেন। এদের কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ পরিচ্ছন্নতা কর্মী, কেউবা গাড়ি চালানোর কাজে যান। কাজ করতে তারা অনাগ্রহী নন, কিন্তু তাদের আগ্রহ নেই কেবল খানিকটা দক্ষতা ও প্রশিক্ষণে, যা তাদের কাজের মূল্যায়ন বাড়িয়ে দেবে আরও অনেক বেশি।

শরিফুল হাসান বলেন, আমাদের দেশের মানুষ কালকেই ৫/৭ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ২০/২৫ হাজার টাকা খরচ করে দক্ষ হবে, একটি সার্টিফিকেট নিবে-এদিকে তাদের মনোযোগ কম। আবার আমাদের সন্তানদের দক্ষ করে তোলার জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের দিকে না পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে থাকি। জাতিগতভাবেও আমরা দক্ষতানির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বহু বছর পিছিয়ে আছি। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে আমাদের তরুণদের বাধ্যতামূলক কারিগরি বা দক্ষতানির্ভর শিক্ষা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এটা করা গেলে সারা দেশে সমানভাবে জনশক্তি রপ্তানির পাশাপাশি প্রবাসী আয়ে সামঞ্জস্য আসবে।